![](https://bonikbarta.biz/uploads/news_image/news_247092_1.jpg?t=1722062847)
চূড়ান্ত ট্রায়ালে কভিড-১৯-এর একটি ভ্যাকসিন সফল হওয়ার খবরে পুরো বিশ্ব মহামারীর অন্ধকারের মধ্যে যেন আশার আলো খুঁজে পেয়েছে। গত সোমবার মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি ফাইজারের ঘোষণা অনুযায়ী, তাদের প্রস্তুতকৃত ভ্যাকসিনটি ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকর। এই খবরে সতর্ক থাকার বেশ কয়েকটি কারণ থাকার পরেও সবাই উল্লসিত। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি বড় বাস্তব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে হবে।
প্রথমতঃ ফাইজার জার্মান প্রাণপ্রযুক্তি কোম্পানি বায়োএনটেকের ভ্যাকসিনটি প্রস্তুত করার স্থান থেকে রোগীর বাহু পর্যন্ত নিয়ে যেতে বিশাল কর্মযজ্ঞের দরকার হবে। তার ওপর ভ্যাকসিনটি মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রা থেকে চারবারের বেশি সরানো যায় না। এটি বাড়িতে ব্যবহৃত সাধারণ ফ্রিজারের গড় তাপমাত্রা থেকে অনেক কম। এতটা কম তাপমাত্রা এর আগের কোনো ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়নি। সুতরাং সাধারণভাবেই বলা যায়- এ ধরনের বিস্তৃত অবকাঠামো কোথাও নেই। ফাইজার স্বীকার করেছে, তাদের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে অতি নিম্ন তাপমাত্রায় তৈরি, সংগ্রহ, বিতরণ ও পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে।
ভ্যাকসিনটি কীভাবে বিশ্ব ভ্রমণ করবে?
স্বল্পমেয়াদে ফাইজারের একটি পরিকল্পনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও বেলজিয়ামের নিজস্ব কেন্দ্রগুলো থেকে এই ভ্যাকসিন বিতরণ করা হবে। এটি স্থল ও আকাশ উভয় পথেই পরিবহনের প্রয়োজন হবে। এবং বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে খুবই উন্নতমানের সংরক্ষণাগারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। তবুও চূড়ান্ত প্রতিবন্ধকতা হলো ক্লিনিক, ফার্মেসি ও স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে ভ্যাকসিনের ডোজগুলো বিতরণ।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফাইজার সুটকেস আকারের একটি বিশেষ ট্রান্সপোর্ট বক্স তৈরি করেছে। ড্রাই আইস বা কঠিনীভবনকৃত কার্বন-ডাই-অক্সাইড ভর্তি এই বাক্সে জিপিএস ট্র্যাকারও ইনস্টল করা রয়েছে। না খোলা পর্যন্ত বাক্সটিতে সঠিক তাপমাত্রায় ৫ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন ১০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। তবে আশার কথা হলো, বাক্সগুলো পুনরায় ব্যবহারযোগ্য। যদিও এই বাক্সটি সস্তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই!
উইল্টশায়ার ভিত্তিক ফার্ম পোলার থার্মালস অন্য ভ্যাকসিনগুলোর জন্য একই ধরনের বাক্স তৈরি করে। সংস্থাটির বিক্রয় প্রধান পল হ্যারিসন বলেন, একটি আদর্শ শীতল পরিবহন বাক্স পাঁচ দিন পর্যন্ত মাইনাস ৮ ডিগ্রি অবধি তাপমাত্রা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। বাক্সটি ১ হাজার ২০০ ডোজ ভ্যাকসিন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন। প্রতি বাক্সের পেছনে খরচ পড়বে প্রায় ৫ হাজার ইউরো। যদিও সেগুলো পরবর্তীতে হাজারবার ব্যবহার করা যেতে পারে। সংস্থাটি ড্রাই আইসের পরিবর্তে ইনসুলেশন হিসেবে এয়ারজেল ব্যবহার করে। তবে আসল কথা হলো, মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পৌঁছাতে না পারায় এটিও ফাইজারের ভ্যাকসিন পরিবহনে ব্যবহার করা যাবে না।
কিন্তু ১০ দিন পর কোথায় সংরক্ষণ করা হবে?
ফাইজার জানিয়েছে, একবার বরফ গলে যাওয়ার পরও তাদের ভ্যাকসিন আরো পাঁচদিন ব্যবহার উপযোগী থাকতে পারে। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে দীর্ঘ পরিবহনের ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিনটির ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাচ্ছে না। ইংল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, সারা দেশে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও বিতরণ উভয় ক্ষেত্রেই ‘জাতীয় প্রস্তুতি’ চলছে।
কিন্তু সাধারণভাবেই অনুমেয় যে, চিকিত্সা ব্যবস্থায় এই ধরনের ফ্রিজ খুবই কম রয়েছে। সুতরাং এত সংখ্যক ফ্রিজার ব্যবস্থা করারও একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ থেকে যাচ্ছে।
আর এটি যে কেবল ব্রিটেনের সমস্যা- এমনও নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা মায়ো ক্লিনিকের ডা. গ্রেগরি পোল্যান্ড রয়টার্সকে বলেন, আমরা একটা বড় মেডিকেল সেন্টার, অথচ আমাদের এই ধরনের সংরক্ষণ সক্ষমতা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা ল্যাবগুলোর মতো কিছু প্রতিষ্ঠানের এই ধরনের ফ্রিজার রয়েছে। অস্থায়ীভাবে তাদের ফ্রিজারগুলো অনুদান বা ভাড়া দেয়ার সম্ভাবনা আছে কি? মহামারীর শুরুতে যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিপিই তৈরির সরঞ্জাম ও ভেন্টিলেটরসহ বিভিন্ন রসদ ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। ফ্রিজারের ক্ষেত্রেও এমনটা করা যেতে পারে।
ফ্রিজারের বৈশ্বিক পরিস্থিতি
এ তো গেল উন্নত দেশগুলোর অবস্থা। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ। গত মাসে বার্তাসংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি) একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুর্কিনা ফাসোতে প্রায় এক হাজার ক্লিনিক্যাল ফ্রিজারের সঙ্কট ছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের সঙ্গে একযোগে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের প্রত্যাশায় কোল্ড স্টোরেজ সুবিধার ম্যাপিংয়ের কাজ করছে। ফিনান্সিয়াল টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, ইউনিসেফের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে স্বল্প আয়ের দেশে ৬৫ হাজার সোলার চালিত কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করা।
ব্রিটেনের ক্র্যানফিল্ড স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের লজিস্টিক্স, প্রোকিউরমেন্ট অ্যান্ড সাপ্লায়-চেইন বিষয়ের অধ্যাপক মাইকেল বোরলাকিস বলেন, আমরা যদি কোল্ড চেইনের দিকে লক্ষ্য করি, তবে দেখবো যে ইউরোপ ও উত্তর
আমেরিকায় একটি শক্তিশালী কোল্ড-চেইন অবকাঠামো রয়েছে। আর আপনি যদি আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু অংশে যান, তবে দেখতে পাবেন এটা খুবই অপ্রতুল্য।
তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখন অন্তত ইতিবাচক থাকি। আমি খুব ভালো করেই জানি যে এটা নিয়ে পরিকল্পনা রয়েছে। সহযোগিতা করার জন্য ও একে-অপরের সঙ্গে তথ্য ভাগাভাগি করে নেয়ার লক্ষ্যে সংস্থাগুলো শেষমুহূর্তে গিয়ে সরবরাহ-চেইনের পরিকল্পনা শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে এটির ব্যপ্তি, জটিলতা ও সক্ষমতার প্রশ্ন অভূতপূর্ব।
বিবিসি অবলম্বনে শিহাবুল ইসলাম