![](https://bonikbarta.biz/uploads/news_image/news_248022_1.jpg?t=1722061973)
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আবদুল আলিম চৌধুরী। ইউরোপীয় দেশ মন্টেনিগ্রোয় ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটন ও ওয়েস্টিন নামে দুটি পাঁচতারকা হোটেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তিনি। ৬ কোটি ইউরো বা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৬০৩ কোটি টাকায় নির্মিতব্য হোটেল দুটি ছাড়াও সেখানকার আবাসন খাতেও বড় অংকের বিনিয়োগ রয়েছে তার। শুধু তাই নয়, মন্টেনিগ্রোয় তার বিনিয়োগকৃত প্রকল্পসংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানগুলোয় সেখানকার ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। উপস্থিত থাকেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রীও।
দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর এ বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের অর্থের উৎস অনুসন্ধান করেছে বণিক বার্তা। সে অনুসন্ধানে উঠে আসা তথ্য বলছে, মূলত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া ঋণের অর্থ বিদেশে পাচারের মাধ্যমেই এ বিনিয়োগ গড়ে তুলেছেন আবদুল আলিম চৌধুরী।
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, দেশের মোট ছয়টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) প্রায় ৪১৬ কোটি টাকার দেনা রয়েছে আবদুল আলিম চৌধুরীর। খেলাপি হয়ে পড়া এ ঋণের অর্থ আদায়ে তার বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে ২৪ কোটি ৮৭ লাখ ৬ হাজার ৫২৫ টাকা, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে ৫৯ কোটি ৭১ লাখ ৯৬ হাজার ৮৪০, ব্র্যাক ব্যাংকে ৩১ কোটি ৬১ লাখ ৬৬ হাজার ১০৫, হাবিব ব্যাংকে ১৬ কোটি ৯৯ লাখ ১৭ হাজার ৩৬৯, প্রাইম ব্যাংকে ৩৫ কোটি ৫৫ লাখ ৫ হাজার ৪০৫, ব্যাংক এশিয়ায় ৩৬ কোটি ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৪ টাকা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের ১৯২ কোটি ৭০ লাখ টাকার ঋণ খেলাপ করেছেন তিনি। আবদুল আলিম চৌধুরীর নামে এ সাত ব্যাংক ও এনবিএফআইয়ের করা মোট ১৯টি অর্থঋণ মামলা ও ১৭টি চেকের মামলা চলমান।
ঋণখেলাপের অভিযোগে দেশের অর্থঋণ আদালতে মামলা চলমান থাকলেও বিদেশে বড় ব্যবসায়ী হিসেবে এরই মধ্যে পরিচিতি পেয়ে গিয়েছেন আবদুল আলিম চৌধুরী। মন্টেনিগ্রো সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের ২৭ জুলাই এআরএনএন গ্রুপের কর্ণধার আবদুল আলিম চৌধুরী একটি পাঁচতারকা হোটেল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। স্থানীয় পর্যটনমন্ত্রী ও সে দেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে মন্ট্রিলভিত্তিক গ্লোবাল সিটিজেনশিপ ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজরি কোম্পানি আরটন ক্যাপিটালের ওয়েবসাইটে জানানো হয়, মন্টেনিগ্রোয় ৬০ মিলিয়ন (৬ কোটি) ইউরোয় নির্মিয়মাণ ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটন ও ওয়েস্টিন হোটেল নির্মাণে বিনিয়োগ করছে এআরএনএন গ্রুপ নামে একটি বিদেশী কোম্পানি। ২০১৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মন্টেনিগ্রোর প্রধানমন্ত্রী মিলো দুকানোভিচ এ নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। মন্টেনিগ্রোর প্রধানমন্ত্রী যখন প্রকল্পকাজ পরিদর্শন করেন, এআরএনএন গ্রুপের কর্ণধার আবদুল আলিম চৌধুরী তখন সেখানেই উপস্থিত ছিলেন।
চট্টগ্রামের এ ব্যবসায়ীর বিদেশে বিনিয়োগকৃত অর্থের উৎস সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে জানা যায়, ২০০৭ সালের দিকে আবদুল আলিম চৌধুরী চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় নামমাত্র মূল্যে কিছু জলাবদ্ধ ও নিচু জমি কিনে নেন। কয়েক গুণ দাম বেশি দেখিয়ে জমিগুলোর বিপরীতে ঋণ নেয়া শুরু করেন তিনি। পরে ওই ঋণের টাকায় আরো কম দামি জমি কিনে তিনি পুনরায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে থাকেন। এ সময়ে দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা না থাকলেও তার আভিজাত্যপূর্ণ চালচলন ও চাকচিক্যের কারণে ব্যাংকগুলোও তাকে ঋণ দিতে দ্বিধাবোধ করত না।
এভাবে এক ব্যাংকের ঋণের টাকা দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় জমি কিনে সেগুলো আবার অন্য ব্যাংকে বন্ধক রেখে নতুন করে ঋণ নেয়ার এক অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করেন তিনি। ব্যাংক কর্মকর্তাদের দেখানোর জন্য ওই সময় আগ্রাবাদে বেশ টাকাপয়সা খরচ করে জাঁকজমকপূর্ণ অফিসও নেন আবদুল আলিম চৌধুরী। ২০১০-১১ সালের দিকে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ধাপে ধাপে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বের করে নেন আবদুল আলিম চৌধুরী।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নিজের ব্যবসায়ী পরিচিতিকে আরেকটু পোক্ত করার জন্য পরে বিদেশ থেকে মাঝেমধ্যে কিছু মেটাল স্ক্র্যাপ আমদানিও করেছেন। ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের পরিকল্পনা থেকে আবদুল আলিম চৌধুরী ২০১০-১১ সালে বিভিন্ন ব্যাংকে মোট আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব খোলেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ক্লিস্টন ট্রেডিং লিমিটেড, ন্যাম করপোরেশন, আলফা ফুডস, ন্যাম ট্রেড ভেঞ্চার, ক্লিস্টন অ্যাকসেসরিজ, আরএ চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ, জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও ভারবি মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ। এসব প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রামে দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই।
বর্তমানে বাংলাদেশে আবদুল আলিম চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো সম্পদ নেই বলে জানা গিয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের বহদ্দারহাট এলাকায় তার একটি সিএনজি পাম্প রয়েছে। এ সিএনজি পাম্পটিও তিনি ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছিলেন। নিজের বাড়িটিও ব্যাংকে বন্ধক রাখা। চট্টগ্রামের ওআর নিজাম আবাসিকের ৫ নম্বর রোডে অবস্থিত ন্যাম হাউজ নামের বাড়িটিরও মালিক তিনি। এছাড়া এর বাইরে দুই-তিনটি গাড়ি, নামমাত্র মূল্যের কিছু নিচু জমি এবং খুলশী ও ওআর নিজাম রোডে তার কয়েকটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবদুল আলিম চৌধুরী বর্তমানে দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। অন্যদিকে দেশেও তার মালিকানায় থাকা টাকাপয়সার তেমন হদিস পাওয়া যায় না। তবে তিনি যে এ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন, আয়কর নথি থেকেও এ বিষয়ে কিছুটা ধারণা মিলেছে।
এতে দেখা যাচ্ছে, এনবিআরের আয়কর বিভাগে সর্বশেষ ২০১৪-১৫ সালের হিসাব বিবরণী জমা দিয়েছেন আবদুল আলিম চৌধুরী। এরপর নিজের আর কোনো আয়-ব্যয় বা সম্পদের হিসাব তিনি দেননি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক থেকে পাওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করার কারণে এবং দেশে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদ বা নগদ অর্থ না থাকার কারণেই হিসাব বিবরণী জমা দিতে পারেননি তিনি। এছাড়া বিপুল অংকের লেনদেন গোপন করায় তার মালিকানাধীন কোম্পানি ক্লিস্টন অ্যাকসেসরিজের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে একটি মামলাও করেছিল আয়কর বিভাগ। এছাড়া আয়কর ফাঁকির অভিযোগে তার আরেকটি কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টও এরই মধ্যে জব্দ করা হয়েছে।
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা থেকে প্রায় ৬০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন আবদুল আলিম চৌধুরী। ব্যাংকটির এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আজম বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের ব্যাংক থেকে আবদুল আলিম চৌধুরী দুটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবের বিপরীতে ঋণ নিয়েছেন, পরে আর ফেরত দেননি। যদিও তখন আমি অন্য ব্যাংকে ছিলাম। পাওনা টাকা না পেয়ে আইনি পথে যেতে হয়েছে। তবে সম্প্রতি তার একটি জায়গার সন্ধান পেয়েছি আমরা। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এটি বিক্রির পদক্ষেপ নেয়া হবে। ব্যবসার কথা বলে তিনি প্রতারণামূলকভাবে টাকা সরিয়েছেন। আমাদের এখন এটা রিকভার করতে হবে।
আবদুল আলিমকে ঋণ দেয়া ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের ব্যাংকেও আবদুল আলিম চৌধুরীর একটি ঋণ রয়েছে। এ ধরনের কেসগুলোয় আসলে গ্রহীতা কর্তৃক শুরু থেকেই প্রতারণার ডিজাইন করা থাকে। অর্থাৎ প্ল্যান করেই টাকা নিয়েছে। পরে সরিয়েছে। এটা সত্যি যে আমাদের ইনফরমেশন সিস্টেম আরো শক্তিশালী থাকা প্রয়োজন। তবে দিনে দিনে সিস্টেমটি ভালো হচ্ছে। যারা অবৈধভাবে টাকা দেশের বাইরে নিয়ে গিয়েছেন, তাদের টাকা ফেরত আনার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ল কোর্টের মাধ্যমে চেষ্টা করছি। মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স আইন অনুযায়ী পৃথিবীর ১০০টিরও বেশি দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে। ক্লায়েন্টের অনিয়ম আঁচ করতে পারলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তখনই নেয়া উচিত। না হলে সময় পেয়ে তারা নিজেদের গুছিয়ে অনেকদূর এগিয়ে যায়। ঋণ নীতিমালা ভঙ্গ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য ব্যাংকের টাকা লোপাট করে টাকা দেশের বাইরে চলে গেলে অপরাধী নিজে ছাড়া আর কোনো পক্ষ নেই, যারা এখান থেকে উপকৃত হবে।