ঘৃণা বাড়ে ধাপে ধাপে আঘাতে আঘাতে

রুহিনা ফেরদৌস

প্রাণিকুলের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্যতম (!) প্রজাতি হিসেবে আমরা মানুষেরা ভেবেছিলাম পৃথিবীর আয়ু ফুরিয়ে গেলেও মহাবিশ্বের কোনো একটি গ্রহে কিংবা অন্য কোনো সৌরজগতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে আশ্রয় খুঁজে নিতে পারে, তার সূচনা আমরা করে যাব। আমরা সে লক্ষ্যেই অগ্রসর হচ্ছিলাম, হচ্ছিও। বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ ব্যয় করে আমরা মহাকাশে বিজ্ঞানীদের পাঠাই। হাজার কোটি টাকা খরচ করে অদৃশ্যে নাম লেখাতে পাঠিয়ে দিই স্যাটেলাইট। পৃথিবী নামের গ্রহের জায়গা দখল করে আমাদের সাধ মেটে না বলে আমরা মহাকাশে নিজেদের নাম ও নিশানা কিনে আত্ম-অহংকার মেখে ঘুমাতে যাই। আমরা মানুষেরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা বা প্রতিযোগিতা দিতে দিতে অদৃশ্য শত্রুর বুকে মিসাইল ছুড়ি। 

সে মিসাইলে মানুষ মরে, ক্ষত বাড়ে প্রকৃতির। সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই আমাদের। আমাদের অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা এত বেশি দীর্ঘ যে অ্যামাজনের আগুনও তা থামাতে পারে না। আমরা পৃথিবীর জমিন ভরিয়ে সমুদ্রে, বনে আমাদের উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে দিই। ধ্বংস হয়ে যায় জল ও জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্র। প্লাস্টিক আবর্জনা পেটে ভেসে ওঠে মৃত তিমি। ওড়া থামিয়ে পাখিরা ধুঁকতে থাকে জীবনসায়াহ্নে। নদী-সমুদ্র থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় কত প্রজাতির জীব। প্রতি বছর ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলে দিই আমরা। পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে কোনো না কোনো স্থানে ফেলে দেয়া চিপসের প্যাকেট প্লাস্টিকের বোতল তার গন্তব্য হিসেবে খুঁজে নিচ্ছে সমুদ্রকে। তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে সেসব এলাকার জীবন, বৈচিত্র্য আর প্রকৃতিকে। পৃথিবীর মানুষের এসব খামখেয়ালি আচরণের দায় প্রকৃতি ও তার প্রাণিকুল বয়ে বেড়াচ্ছে সবসময়।

একটা তথ্য দিই, ২০১৫ সাল নাগাদ পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিকপণ্য। যার মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশকে পুনরায় ব্যবহার ও ১২ শতাংশ পুুড়িয়ে নষ্ট করা হলেও বাকি ৭৯ শতাংশই পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশে জমা আছে।

ম্যাসাচুসেটস ইনিস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা এক বছর থেকে গবেষণা চালিয়ে বলেছেন যে এসব প্লাস্টিক হাজার হাজার বছরেও ধ্বংস হবে না। ২০১৮-এর নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ায় একটি তিমির পাকস্থলীতে ১১৫টি কাপ, চারটি প্লাস্টিকের বোতল, ২৫টি প্লাস্টিকের ব্যাগ এবং দুই জোড়া প্লাস্টিকের চপ্পল পাওয়া যায়। বিশ্বজুড়েই সমুদ্রে প্লাস্টিকের আবর্জনা বাড়ছে। ২০১৫ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী বছরে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে প্রায় ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক। গত বছরই গবেষণায় উঠে এসেছে যে আগামী দশকের মধ্যে সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ তিন গুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ পর্যায়ে আমাদের দেশের দিকে চোখ ফেরানো যাক। পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে গত বছরের নভেম্বরের প্রতিবেদন বলছে, পদ্মা থেকে বঙ্গোপসাগরে পড়ছে ৩০০ ধরনের প্লাস্টিকপণ্য। যার মধ্যে কোমল পানীয়র বোতল থেকে শুরু করে থালা, কসমেটিকসের মোড়ক, নিত্যব্যবহার্য থালা-জগ সবই আছে। যেখানে সেখানে কফ-থুতুসহ যেকোনো ময়লা ফেলার জন্য জাতি হিসেবে আমরা অন্যদের চেয়ে খানিকটা যে এগিয়ে আছি তা বোধকরি কেউ অস্বীকার করবেন না।

এই তো কয়েক দিন আগেও পৃথিবী কেবল ধোঁয়া ও দূষণে ছেয়েছিল। তথ্য বলে, অ্যামাজন বনে আগুন লাগার ঘটনা আগের তুলনায় ৮০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহর সাও পাওলোয় সূর্যাস্ত হওয়ার পূর্বাভাস সন্ধ্যা ৫টা ৫১ মিনিটে থাকলেও ২ ঘণ্টা আগেই পুরো শহরটি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। দুটি কারণ ছিল এর পেছনে। প্রথম, দক্ষিণ মেরু থেকে আসা ঠাণ্ডা আবহাওয়া, দ্বিতীয় আমাজনে লাগা আগুনের ধোঁয়া। ধারণা করা হয়, সাও পাওলোতে ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরের আমাজনের দাবানল থেকে ওই ধোঁয়া উড়ে এসেছিল।

বিশ্বব্যাপী গরুর মাংসের অন্যতম রফতানিকারক রাষ্ট্র ব্রাজিল। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেয়ার পর কৃষিকাজ ও খনিজ শিল্পের জন্য বনাঞ্চল বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো। বলা হয়, এর পর থেকে দাবানলের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তখন থেকে এ পর্যন্ত আমাজনে অন্তত ৭২ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্যমতে ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইএনপিই) জানিয়েছে, ২০১৯  সালে ব্রাজিলে আগুন লাগার ঘটনা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৮০ শতাংশ বেশি। স্যাটেলাইটের পাঠানো ছবিতেও ধরা পড়েছে বনের বিশাল অংশ উধাও হওয়ার চিত্র। নির্বাচনী প্রচারণার সময় আমাজনের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অনুসন্ধানের মাধ্যমে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বোলসোনারো। প্রেসিডেন্টের পশু চাষকে আশকারা প্রদানের পরিণতি হিসেবে ধুঁকছে আমাজন রেইন ফরেস্ট।

যদিও বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে ইটভাটার সংখ্যা ৫৯ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৩ সালে সারা দেশে ৪ হাজার ৯৫৯টি ইটভাটা ছিল। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৯০২টি। এর মধ্যে ঢাকা ও এর পাশের গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় মোট ১ হাজার ৩০২টি ইটভাটা আছে। শুধু ঢাকা জেলাতেই ইটভাটা আছে ৪৮৭টি। বাংলার পুরনো মানচিত্রের নদ-নদী একালের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। নদীহীন হচ্ছে ঢাকাও। রাজধানী বাড়ছে দৈর্ঘ্য-প্রস্তে। একশ্রেণীর মানুষ যে যার মতো করে উন্নয়নের সুফল লুটতে ব্যস্ত।

দাম্ভিক ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশ আগেভাগেই ঘোষণা দিয়েছেন বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিলে কানাকড়িও দেবেন না তিনি। আমেরিকার এ ৭৩ বছরের প্রৌঢ় প্রতিযোগিতা করছেন গ্রেটা থুনবার্গ নামে সুইডেনের ১৭ বছর বয়সী কিশোরীর সঙ্গে। এদিকে সিরিয়ার শরণার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এ যুগের চরম মানবিক সংকট সৃষ্টির নেপথ্য কারিগররা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এ সংকট বৃদ্ধির পাঁয়তারা করছেন। দারিদ্র্য ও হতাশা থেকে পলায়নরত আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গরা সাহারা মরুভূমি পার হয়ে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে এসে মরচে পড়া জাহাজ কিংবা নৌকায় চড়ে ইউরোপের উন্নত জীবনে প্রবেশ করার আগেই খরচ হয়ে যাচ্ছে। রোজকার গোলাবারুদ ত্রাস থেকে বাঁচতে সাগরে ডুবে মরছে মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থী দলগুলো। এদিকে কেউ কেউ পৃথিবীতে বোরড (একঘেয়ে) হয়ে গেছেন বলে টিকিট কেটেছেন মঙ্গলের।

যদিও এ মুহূর্তে হঠাৎ করোনাভাইরাস এসে থামিয়ে দিয়েছে অনেক কিছু। খতিয়ান খাতা খুলে বসেছেন পুঁজিপতিরা। সময় বলছে, পৃথিবীর মানুষকে সম্পদের ব্যবহার শিখতে হবে। শিখতে হবে ঘৃণা কমানোর সূত্র। অন্যথায় প্রতি ১০০ বছর পর পৃথিবীতে প্লেগ-ইনফ্লুয়েঞ্জা-ফ্লুর মতো অস্ত্র পাঠাতে হবে মানুষের হুঁশ ফেরানোর জন্য।

কে যেন কক্সবাজারের একটি ভিডিও পোস্ট করে লিখেছেন সমুদ্রসৈকতের কাছাকাছি ডলফিনদের ডুবসাঁতার আর খুনসুটির কথা। চীনের উহানে মদের গুদামে হানা দেয়া হাতির দল সবকিছু তছনছ করে, মাড়িয়ে, পান করে ক্লান্ত হয়ে পাশের চা বাগানে সুখনিদ্রায় ডুবেছে সেদিন কিংবা ঢাকা শহরের মোটামুটি শব্দহীন এই দিনরাত্রি কতটা কাঙ্ক্ষিত ছিল ভীত চড়াই-শালিখদের।

জাতিসংঘ বলছে, পৃথিবীর ওজোন স্তরের ক্ষত সেরে উঠছে। জেগে উঠছে জগতের অন্যান্য পতঙ্গ-প্রাণিকুল। ২০২০ সালের প্রযুক্তিময়তার কালে করোনার এ সংক্রমণ পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য মেনে চলার কথা। প্রকৃতির দম বন্ধ করে মানুষ একার জন্য অক্সিজেন মজুদ করতে সফল হবে না। মানুষকে বাঁচতে শিখতে হবে প্রকৃতিকে সমীহ করে; তার প্রাণী, জীবন ও জীবকুলের ক্ষতি ও ক্ষত তৈরি না করে। মানুষকে শিখতে হবে যূথবদ্ধতার কথা, যৌথতার কথা। তাকে মুখস্থ করতে হবে ‘একক অর্জন একক সমৃদ্ধি স্থায়ী নয়’ কথাটি।

মানুষকে পৃথিবী ও অন্য মানুষের কান্না শুনতে হবে। করোনাভাইরাস-পরবর্তী ধকল কাটিয়ে যারা টিকে থাকবে, তাদের মনে রাখা জরুরি পৃথিবীর ঘৃণা বাড়িয়ে মানুষের অর্জনের লড়াই সফল হয় না।

কান্নাকে যাবে না দেখা, যেমন বৃক্ষের বীজগুলো

অবিরাম ঝরে পড়ে, অলক্ষেই, মাটির ওপর—

এমনকি আলোকেরও অগোচরে বেড়ে ওঠে

যার দীর্ঘ অন্ধ পাতাগুলো।

ঘৃণা বাড়ে ধাপে ধাপে, আঘাতে আঘাতে,

—কথাগুলো পাবলো নেরুদার ‘একনায়কেরা’ কবিতা থেকে নেয়া হয়েছে।

রুহিনা ফেরদৌস: সাংবাদিক


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন