পলল গঠিত
সমভূমির জেলা
দিনাজপুর। হিমালয়
বিধৌত অঞ্চল।
হিমালয় পর্বতের
ঢাল হিসেবে
পরিচিত। শীতকালে
তাপমাত্রা হিমাঙ্কের
কাছাকাছি সর্বনিম্ন
৩ ডিগ্রি
সেলসিয়াসে নেমে
আসতে দেখা
যায়। আর
চৈত্র, বৈশাখ
ও ভাদ্র
মাসে খরতাপের
সময় তাপমাত্রা
৩৯ ডিগ্রি
পর্যন্ত ওঠে।
গড় তাপমাত্রা
২৫-৩০
ডিগ্রি সেলসিয়াস।
দেশের খাদ্যভাণ্ডার
হিসেবে খ্যাত
প্রতি বছর
৩ লাখ
৫০ হাজার
হেক্টরে আমন,
২ লাখ
৭৫ হাজার
হেক্টরে বোরো
এবং ২৫
হাজার হেক্টরে
আউশ ধানের
চাষ হয়।
আলু চাষ
হয় ২৫
হাজার হেক্টর
জমিতে। সমপরিমাণ
জমিতে হয়
গমের চাষ।
এছাড়া দিনাজপুরে
প্রচুর টমেটো,
করলা, শীতকালীন
সবজি ফুলকপি,
বাঁধাকপি, শিম,
বরবটি, ঢেঁড়শ,
বেগুন, মুলা,
শসা, ঝিঙেসহ
বিভিন্ন ধরনের
শাকসবজি চাষ
হয়। খাদ্য
উৎপাদনে দেশের
সবচেয়ে উদ্বৃত্ত
জেলা দিনাজপুর।
দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী
কাটারী ভোগ
চাল ও
চিড়ার খ্যাতি
দেশজুড়ে। এছাড়া
গোপালভোগ আম
ও বেদানা
লিচুর কদর
দেশ ছাড়িয়ে
পৌঁছে গেছে
বিদেশে। জেলার
মুগ ডালের
পাঁপড় ও
শহরের মাড়োয়ারি
সম্প্রদায়ের তৈরি
শর্মার পাঁপড়ের
রয়েছে বিশেষ
চাহিদা। মানুষের
প্রধান পেশা
কৃষি। প্রধান
শিল্প ও
ব্যবসা কৃষির
সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
এ অঞ্চলের
মানুষের প্রধান
কাজ বছরজুড়ে
ফসল ফলানো।
মানুষ রাজনৈতিকভাবে
সচেতন। বিশেষ
করে বাম
ঘরানার রাজনীতি।
ইংরেজ আমল
থেকে কৃষিপ্রধান
এ অঞ্চলে
তেভাগা আন্দোলন,
টঙ্ক আন্দোলন,
কৃষক অধিকার
আন্দোলন, কমিউনিস্ট
আন্দোলন গড়ে
উঠতে দেখা
গেছে। সংস্কৃতি
চর্চা, পাঠাগার
ও খেলাধুলার
প্রতি দিনাজপুর
জেলার বিশেষ
ঐতিহ্য দীর্ঘকালের।
সংস্কৃতিচর্চা ও
ক্রীড়া ক্ষেত্রে দিনাজপুর
২১
জুন দিনাজপুর
তথা দেশের
অন্যতম প্রাচীন
নাট্য ও
সাংস্কৃতিক সংগঠন
‘দিনাজপুর
নাট্য সমিতি’
১০৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
পালন করেছে।
দিবসটি উপলক্ষে
ওইদিন সন্ধ্যায়
নাট্য সমিতি
মঞ্চে সংগঠনটির
পরিচালনা পরিষদ
ও সদস্য
কর্মীরা কেক
কেটে আলোচনা
সভা আয়োজনের
মধ্য দিয়ে
দিবসটি পালন
করেছেন। ১৯১৩
সালের ২১
জুন ভুপাল
সেন গুপ্তর
নির্দেশনায় ট্যাঙ্গর
চক্রবর্তী অভিনীত
‘চন্দ্রগুপ্ত’
নাটক দিয়ে
শুরু হয়েছিল
নাট্য সমিতির
জয়যাত্রা। ১০৯
বছর পূর্তির
প্রাক্কালে ২৪
ও ২৫
জুন নাট্য
সমিতি মঞ্চস্থ
করছে কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
রক্তকরবী অবলম্বনে
নাটক ‘নন্দিনীর
পালা’।
দীর্ঘ পথপরিক্রমায়
দিনাজপুর তথা
সারা দেশে
বাঙালি সংস্কৃতিচর্চা
ও বিকাশ
বিশেষ করে
নাট্যচর্চায় নিরলস
ভূমিকা পালনের
জন্য ‘শিল্পকলা
পদক-২০২০’
লাভ করেছে।
দিনাজপুর নাট্য
সমিতি দেশের
একটি ঐতিহ্যবাহী
নাট্য ও
সাংস্কৃতিক সংগঠন।
১৯১৩ সালে
দিনাজপুর শহরের
বাহাদুরবাজার এলাকায়
সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত।
মোট ২৬
শতক জমির
ওপর প্রতিষ্ঠিত
সংগঠনটির নিজস্ব
মিলনায়তন ছাড়াও
একাধিক রিহার্সেল
রুম ও
কার্যালয় আছে।
দিনাজপুর নাট্য
সমিতির একাধিক
প্রকাশনা সূত্রে
জানা গেছে,
তত্কালীন অবিভক্ত
ভারতের কলকাতা,
ঢাকাসহ বিভিন্ন
জেলার বাংলা
নাটক ও
সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম
পাদপীঠ ছিল
দিনাজপুর নাট্য
সমিতি। বাংলা
সাহিত্য ও
সংস্কৃতির দিকপালদের
সরব উপস্থিতিতে
মুখর থাকত
সংগঠনটি।
দিনাজপুর নাট্য
সমিতি শতবর্ষ
ধরে বাঙালি
সংস্কৃতি ও
বাংলাদেশের নাট্যচর্চার
প্রসার ও
বিকাশে তাত্পর্যপূর্ণ
ভূমিকা পালন
করে আসছে।
মূলধারার সংস্কৃতি
চর্চার ক্ষেত্রে
স্বাধীনভাবে থিয়েটারচর্চার
লক্ষ্যে শতবর্ষ
আগে যাত্রা
করেছিল দলটি।
বাংলা সাহিত্য
ও সংস্কৃতির
বহু উল্লেখযোগ্য
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়
দিনাজপুর নাট্য
সমিতির এ
দীর্ঘ যাত্রাপথে
কখনো না
কখনো, কোনো
না কোনোভাবে
সংযুক্ত হয়েছিলেন
নাট্যদলটির সঙ্গে।
কথাশিল্পী শরত্চন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর
বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্মথ
রায় (টুকু
বাবু), বিপিন
চন্দ্র পাল,
মুকুন্দ দাস,
পিসি সরকার,
এরা অনেকে
কলকাতা থেকে
দিনাজপুরে এসে
নাট্য সমিতি
মঞ্চে প্রত্যক্ষ
করতে এসেছিলেন,
দিনাজপুরের শিল্পীরা
কীভাবে তাদের
লেখা নাটকের
চরিত্রে রূপদান
করেন।
কুমার রায়,
শিবপ্রসাদ কর,
বাংলা যাত্রা
শিল্পের দিকপাল
শম্ভু মিত্র,
লেখক এমআর
আক্তার মুকুল,
ভাস্কর নিতুন
কুন্ডু, অভিনেতা
ও চলচ্চিত্র
পরিচালক সুভাষ
দত্ত প্রমুখ
সরাসরি দিনাজপুর
নাট্য সমিতি
মঞ্চে অভিনয়
করেছেন। উল্লিখিত
ব্যক্তি ছাড়াও
দিনাজপুর নাট্য
সমিতি মঞ্চে
যারা নিয়মিত
অভিনয় করেছেন,
তাদের মধ্যে
কালি নন্দী,
মুকুল সেন,
প্রভাত দাস
গুপ্ত (ফটিকদা),
সুধীর বাবু,
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র
পরিচালক রাজেন
তরফদার, সত্যেন
মজুমদার, মিন্টু
চৌধুরী, নিমু
সেন, খোকাদা,
কালি নন্দী
ছোট), সুলতান
সরকার, তালেব
আলী, বদ্রি
নারায়ণ ধর
এমন আরো
অনেক উজ্জ্বলতম
নাট্যশিল্পী রাতের
পর রাত
দিনাজপুর নাট্য
সমিতি মঞ্চে
নিয়মিত অভিনয়
করেছেন। দিনাজপুর
নাট্য সমিতি
তত্কালীন কলকাতার
নবনাট্য আন্দোলনের
সঙ্গে সরাসরি
যুক্ত ছিল।
কিন্তু ১৯৪৭
সালে দেশভাগের
পর এবং
পরবর্তী সময়ে
উল্লিখিত অনেক
শিল্পী দিনাজপুর
ছেড়ে পাড়ি
জমান কলকাতায়।
স্বাধীনতার আগ
পর্যন্ত প্রতি
শনিবার সাপ্তাহিক
ছুটির আগের
দিন নিয়মিত
নাট্য মঞ্চায়নের
ঐতিহ্য ছিল
দিনাজপুর নাট্য
সমিতির। পূর্ব
বাংলার প্রথম
নাট্য সংগঠন
হিসেবে প্রায়
প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই
টিকিটের বিনিময়ে
নাটক প্রদর্শনীর
ঐতিহ্য অব্যাহত
রেখেছে দিনাজপুর
নাট্য সমিতি।
১৯৬৩ সাল
থেকে দিনাজপুর
নাট্য সমিতি
তত্কালীন পূর্ব
পাকিস্তানের মধ্যে
প্রথম মাসব্যাপী
নাট্যোৎসব আয়োজনের
দায়িত্ব নেয়,
যা স্বাধীনতা-পরবর্তীকালেও
অব্যাহত আছে।
১৯৬৩-২০২২
পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি
২২টি মাসব্যাপী
জাতীয় ও
আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব
ও প্রতিযোগিতার
আয়োজন করেছে।
১৯৭৪ সালে
নাট্য সমিতি
সাড়ম্বরে সংগঠনটির
সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব
পালন করে।
২০১৩ সালে
দীর্ঘ এক
বছরব্যাপী নানা
অনুষ্ঠান আয়োজনের
মধ্য দিয়ে
দিনাজপুর নাট্য
সমিতি শতবর্ষ
উৎসব পালন
করেছে।
দিনাজপুরের সংস্কৃতিচর্চার
ওপর বিভিন্ন
বিদগ্ধজনের লেখা
থেকে জানা
যায়, ১৯১৩
সালে দিনাজপুর
নাট্য সমিতি
প্রতিষ্ঠার আগে
দিনাজপুরে ‘ডায়মন্ড
জুবিলী’ নামে
আরো একটি
নাট্য প্রতিষ্ঠান
ছিল। পরবর্তী
ইংরেজ আমলেই
শহরের কালিতলা
নামক মহল্লায়
‘আর্যপুস্তকাগার’
নামে একটি
পাঠাগার, ক্রীড়া
ও সাংস্কৃতিক
সংগঠন জন্ম
হয়। যদিও
বর্তমানে সংগঠনটির
কর্মকাণ্ড স্তিমিত
হয়ে পড়েছে।
এরপর ১৯৬৮
সালে ‘নবরূপী’
নামে দিনাজপুরে
আরো একটি
নাট্য ও
সাংস্কৃতিক সংগঠনের
আত্মপ্রকাশ ঘটে।
৫০ বছরের
অধিককালব্যাপী সংগঠনটি
দিনাজপুরের নাট্য
ও সাংস্কৃতিক
অঙ্গনে উজ্জ্বল
ভূমিকা রেখে
চলেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী
শহরের বাহাদুরবাজার
এলাকায় গড়ে
ওঠে
‘বৈকালী
নাট্যগোষ্ঠী’।
স্বাধীনতা-পরবর্তী
১৯৮৪ সালে
দিনাজপুর শহরে
বাংলাদেশ উদীচী
শিল্পীগোষ্ঠী দিনাজপুর
জেলা সংসদ
প্রতিষ্ঠা লাভ
করে। প্রতিষ্ঠার
পর থেকে
অদ্যাবধি উদীচী
দিনাজপুরে সাংস্কৃতিক
আন্দোলন ও
সংগ্রামে কার্যকরী
ভূমিকা রেখে
চলেছে। এছাড়া
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত
সম্মিলন পরিষদ,
পুনর্ভবা থিয়েটার,
আমাদের থিয়েটার,
দোলনচাঁপা সংগীত
নিকেতন, ‘গ্যালারী
ষড়ং’ ‘সুরলোক
সংগীত একাডেমি’
বেতার ও
টেলিভিশন শিল্পী
সংস্থাসহ অনেক
সাংস্কৃতিক সংগঠন
দিনাজপুর জেলার
মানুষের মাঝে
সাংস্কৃতিক চেতনা
লালন ও
বিকাশে কাজ
করে চলেছে।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের
পাশাপাশি ক্রীড়া
ক্ষেত্রেও দিনাজপুর
জেলার ভূমিকা
প্রশংসনীয়। পাকিস্তান
আমলে ‘ফুটবলের
যাদুকর’ খ্যাত
আব্দুস সামাদের
বাড়ি দিনাজপুরের
পার্বতীপুর উপজেলায়।
দিনাজপুর গোর
এ শহীদ
বড় ময়দান
দেশের সর্ববৃহৎ
মাঠ। সারা
বছর ধরে
এ মাঠে
দিনাজপুর শহরের
বিভিন্ন ক্লাব
ও ক্রীড়া
প্রতিষ্ঠান ফুটবল,
ক্রিকেট, হকি
খেলা চর্চা
ও টুর্নামেন্টের
আয়োজন করে
চলেছে। দিনাজপুরের
ধীমান দাস
একসময় জাতীয়
ক্রিকেট দলের
সদস্য ছিলেন।
বর্তমান জাতীয়
ক্রিকেট দলের
লিটন দাস
দিনাজপুরের সন্তান।
জাতীয় খেলা
কাবাডিতে দিনাজপুর
জেলা দীর্ঘদিন
চ্যাম্পিয়ন খেতাব
ধরে রেখেছিল।
দুই দশক
ধরে দেশের
সেরা কাবাডি
কোচ ও
রেইডার হিসেবে
দিনাজপুরের জলিল,
জালাল ও
জিয়াউর রহমান
তিন সহোদর
আজও দায়িত্ব
পালন করছেন।
জাতীয় জিমন্যাস্টে
দিনাজপুর জেলার
একক আধিপত্য
দীর্ঘদিনের। শরীরচর্চার
ক্ষেত্রে দিনাজপুর
বডিবিল্ডিং ক্লাব,
বালুবাড়ী বডিবিল্ডিং
ক্লাব, মডার্ন
বডিবিল্ডিং ক্লাব,
আর্য পাঠাগার
বডিবিল্ডিং ক্লাব,
রামনগর বডিবিল্ডিং
ক্লাব, সুইহারী
বডিবিল্ডিং ক্লাব
দিনাজপুরের ছেলে-যুবকদের
শরীর গঠন
ও চর্চায়
কাজ করে
চলেছে। মোহাম্মদ
আলী, মো.
রফিকুল ইসলাম
দিনাজপুর থেকে
মি. ইস্ট
পাকিস্তান খেতাব
অর্জন করেন।
পরবর্তী সময়ে
দেশ স্বাধীন
হওয়ার পর
শরীরচর্চায় দিনাজপুরের
একাধিক প্রতিযোগী
মি. বাংলাদেশ
খেতাব অর্জন
করেছেন।
কৃষির উর্বর
ক্ষেত্রের পাশাপাশি
সংস্কৃতি ক্রীড়াজগতে
দিনাজপুরের যে
অনন্য ভূমিকা
তা সর্বজনস্বীকৃত।
কেবল সংবাদমাধ্যমে
তুলে ধরার
ক্ষেত্রে পিছিয়ে
থাকার কারণে
প্রচারে দিনাজপুর
পিছিয়ে আছে।
আসাদুল্লাহ্ সরকার: সাংবাদিক