সিল্করুট

অভিবাসীদের আবাসভূমি

আশরাফী বিনতে আকরাম

১৯৮৫ সালে আরনেস্ট রাভেন্সটাইন তার অব মাইগ্রেশন বইতে লিখেছিলেন, মানুষ দুটি কারণে নিজ দেশের সীমানা অতিক্রম করে অথবা দেশের অভ্যন্তরে নিজের বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বসবাস করে। অভিবাসনের পশ্চাতে মানুষের ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছা উভয়ই দায়ী। তিনি তত্ত্বকে অর্থনীতির আলোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। বর্তমান লেখাটি উত্তরাঞ্চলের জেলা দিনাজপুরের অভিবাসনকেন্দ্রিক। ভৌত-পরিবেশগত কারণে (অনুকূল আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব কম) একদিকে জেলায় বহিরাগতদের যেমন অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে, তেমনি অতীতে ধান উৎপাদনের প্রাচুর্য স্থানীয় অধিবাসীদের করেছে কর্মবিমুখ, সে সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছেন বহিরাগত বণিক শ্রেণী। তাদের জন্য দিনাজপুর ছিল Hunting Ground (আলী, ২০০২) ঐতিহাসিকভাবে মুর্শিদাবাদ, হরিয়ানা, বিহার, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, মালদহ, সাঁওতাল পরগনা, ছোট নাগপুর থেকে আগত সম্প্রদায়গুলোর আবাসস্থল হয়েছে দিনাজপুর

বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনব্যবস্থা সূচনায় সৃষ্ট আদি জেলা শহরগুলোর অন্যতম পুরনো শহর ছিল দিনাজপুর। তবে নবাবি আমলে দিনাজপুরের শহর বলতে ঘোড়াঘাটকে (বর্তমান দিনাজপুরের একটি উপজেলা) বুঝানো হতো। সে সময় দিনাজপুর ছিল একটি মৌজার নাম, যেখানে মহারাজা বাহাদুরের রাজবাড়ী অবস্থিত (দিনাজপুর গেজেটিয়ার, ১৯১২) পরবর্তী সময়ে রাজার সম্মানার্থে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জেলার নামকরণ করা হয় দিনাজপুর (আলী, ২০০২) তবে জেলার নামকরণের ইতিহাস আরো পুরনো। সেটি আরেকটি লেখা গবেষণার বিষয় হতে পারে। লেখক বর্তমান লেখনীর মাধ্যমে দিনাজপুরের অভিবাসিত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের গল্প শোনাবেন, যারা ভৌগোলিক অর্থনৈতিক কারণে দিনাজপুরে স্থায়ীভাবে থিতু হয়েছেন।

ধানকেন্দ্রিক উৎপাদনে দিনাজপুর অর্থনৈতিকভাবে এক সময় বেশ সমৃদ্ধ ছিল, যা স্থানীয়দের অলস করে তোলে। স্থানীয়দের ব্যবসায়ে অমনোযোগিতার সুযোগ নেন মারোয়াড়ি সম্প্র্রদায়। যারা মূলত ব্যবসার উদ্দেশে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের রাজস্থান অঞ্চল থেকে দিনাজপুরে আসেন। বুকানন হ্যামিল্টনের মতে, মূলত উনিশ শতকের প্রথম দশকে জেলায় মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীরা স্থায়ী হতে শুরু করেন (আহমেদ, ১৯৯৬) তিনি আরো বলেন, মারোয়াড়িরা প্রথমে ব্যাংকিং ব্যবসা দিয়ে দিনাজপুরে তাদের ব্যবসা শুরু করেন, যা ১৯৪৭ সাল অবধি ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। বর্তমান লেখক যখন মাঠ পর্যায়ে তার দল নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন, তখন শহরের চকবাজার এলাকায় লোহিয়া বিল্ডিং নামে একটি ভবন তার দৃষ্টিগোচর হয়। পরবর্তী অনুসন্ধানে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানতে পারেন লোহিয়া একজন ধনী মারোয়াড়ি ছিলেন। ভবনে তার অফিস ব্যাংক ছিল। বাংলা ১৩৭১ নির্মিত (ইংরেজি ১৯৬৪-১৯৬৫) ভবনটি আজও দিনাজপুর শহরে মারোয়াড়িদের ব্যাংকিং ব্যবসার প্রসারের সাক্ষ্য বহন করছে।

বিশ শতকের শুরুর দিক থেকে মাঝামাঝি অবধি মারোয়াড়িরা দিনাজপুরে বস্ত্র ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমান শহরের অন্যতম ব্যস্ততম কেন্দ্র মালদহপট্টি (চলতি নাম মালদাপট্টি) প্রায় অনেক ব্যবসাই মারোয়াড়িদের অধীনে। তাই এক সময় মালদহ পট্টির পূর্ব নাম ছিল মারোয়াড়িপট্টি। তবে মারোয়াড়িরা মারোয়াড়ি ভাষায় কথা বলত, যা স্থানীয় বাঙালিরা বুঝতে পারত না। তাই তারা কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলত, কি হেরা কাই কাই করিছে, তাদের কাই কাই থেকেই মূলত ব্রিটিশ আমলে মালদহপট্টির নামকরণ হয় কাইয়াঁপট্টি (আলী, ২০০২; সাক্ষাত্কার মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী বিমল আগারওয়াল, ২০/০৬/২০২২) তবে কাইয়াঁপট্টিকে কেন মালদাপট্টি বলা হয় সে প্রসঙ্গে আগারওয়াল বলেন, সব ধরনের মালের দেয়া-নেয়া হতো বলে বর্তমান এলাকাটির নাম মালদাপট্টি।

তবে ব্যবসায়ীরা শুধু বস্ত্র নয়, পরবর্তী সময়ে পাট, ধান, তেল এমনকি চিনির ব্যবসায় শহরে প্রসার লাভ করেন। বিমল আগারওয়াল বলেন, অধিকতর ব্যবসায়িক মনোভাব অভিবাসী হওয়ার দরুন তারা মূলধারার বাঙালিদের সঙ্গে মেশার ক্ষেত্রে এখনো বেশ রক্ষণশীল। বর্তমানে সমগ্র বাংলাদেশে ৪৩৮টি, তন্মধ্যে দিনাজপুরে মাত্র ৪২টি মারোয়াড়ি পরিবার আছে। যাদের মধ্যে একটি মুসলিম বাকি সব হিন্দু। তবে শুধু মারোয়াড়িরা নয়, শহরে প্রথম ব্যবসার ভিত্তি যারা গড়েন তারাও বহিরাগত হিন্দু ছিলেন। চন্দ্রসাহা, ঈশ্বরসাহা, মহেন্দ্রসাহা, চারু রায়, ভূটিবাবু, চিত্তসাহা, গোপাল ভৌমিক প্রমুখ ব্যবসায়ীদের বাপ-দাদাদের আদি জন্মস্থান দিনাজপুর ছিল না (আলী, ২০০২) এছাড়া বর্তমান দিনাজপুরের বুকে আরো অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের স্বত্বাধিকারীরা অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে জেলার বুকে বসতি স্থাপন করেছেন। শহরের বিখ্যাত পাবনা সুইটসের মালিক, বাহাদুর বাজারের বিখ্যাত ব্যবসায়ী আবুল হোসেন পাটোয়ারী, চকবাজারের মৃগয়া হোটেলের মালিক মনোরঞ্জন সাহা যথাক্রমে পাবনা, নোয়াখালী ফরিদপুরের আদি বাসিন্দা।

দিনাজপুরে হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মের বিহারিরা বসবাস করেন। অবিনাশ কুমার সাহা শহরের চকবাজার এলাকার (স্থানীয়ভাবে গুদড়ি বাজার বা পশ্চিমাপট্টি নামে পরিচিত) আটার মিলের মালিক। সাক্ষাত্কারে জানান, তারা দিনাজপুরে হিন্দু বিহারি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় সাহার দাদু দেশে ব্যবসার জন্য আসেন। বিহারিরা ভোজপুরি বা দেশওয়ালি নামে পরিচিত। কারণ তারা তাদের বিহারের আঞ্চলিক ভাষা ভোজপুরিতে কথা বলেন। যেহেতু তারা পশ্চিমা থেকে এসেছেন, তাই তাদের জন্য এলাকাটি পশ্চিমাপট্টি নামেও পরিচিত। দিনাজপুরের বিহারিরা মূলত ব্যবসার উদ্দেশে সরাসরি বিহার থেকে এখানে অভিবাসিত হন। তন্মধ্যে দিনাজপুর শহরের চকবাজার এলাকায় প্রায় ১০০ এবং খালপাড় এলাকায় ৬০টি ভোজপুরি পরিবার রয়েছে। চকবাজার এলাকার ভোজপুরি পরিবারগুলো সংস্কৃতি ধর্মচর্চার দিক থেকে তারা বিহার অঞ্চলের নিয়মনীতি অনুসরণ করেন, যা স্থানীয় হিন্দুদের থেকে আলাদা। বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করলেও চকবাজারের বিহারিরা মূলত পাঁপড় ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে, শহরের স্টেশন এলাকার মুসলিম বিহারি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাও মূলত ব্যবসার উদ্দেশে বিহার থেকে জেলায় আসেন এবং বর্তমানে তারা ব্যবসাই করছেন। তবে মুসলিম বিহারিরা উর্দু-হিন্দি মিশেলে কথা বলেন। মুসলিম বিহারিদের আলাদা কোনো সংগঠন না থাকায় তাদের সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায়নি। তবে দিনাজপুরে কোনো বিহারি ক্যাম্প নেই। ফলে জেলায় বিহারিরা অন্যন্যা জেলার বিহারিদের মতো ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করেন না কিংবা স্থানীয় বাঙালিদের থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো জনগোষ্ঠী হয়েও থাকেন না। এছাড়া শহরের মুচি, ডোম, চামার দলিত শ্রেণীর পূর্বপুরুষরা উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার থেকেই এসেছে। যাদের প্রসঙ্গে বিশ্বাস (২০১২) বলেন, বাংলাদেশে অবাঙালি দলিত শ্রেণীর পূর্ব-পুরুষরা ব্রিটিশ শাসনামলের মাঝামাঝি (১৮৩৮-৫০) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকর্মী, চা-বাগানের শ্রমিক, জঙ্গল কাটা, পয়োনিষ্কাশন প্রভৃতি কাজের জন্য ভারতের উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, ওড়িশা, কোচবিহার, রাচি, মাদ্রাজ আসাম থেকে হিন্দি, ওড়িশা, দেশওয়ালি তেলেগু ভাষাভাষী এসেছিল।

বর্তমানে জেলায় প্রধানত পাঁচটি গোত্রের আদিবাসীদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তন্মধ্যে সাঁওতালরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এছাড়া ওঁরাও, মালপাহাড়ি, মুসহর মুণ্ডারি সম্প্রদায়। ১৭৮০-৮২ সালে ইংরেজ সরকার কর্তৃক দেওয়ান নিযুক্ত হন দেবী সিংহ নামক এক অত্যাচারী শাসক (আলী, ২০০২) খাজনা আদায় নিয়ে কৃষকদের প্রতি নিদারুণ অত্যাচার চালাতেন তিনি। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই জেলার কৃষি ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছিল। ১৭৮৩ সালের দিকে দেবী সিংহের পতনের পর দেওয়ান নিযুক্ত হন রাজমাতুল জনকীরাম। তিনি দিনাজপুরের কৃষি ব্যবস্থা সচল রাখতে ছোটনাগপুর, ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগনা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে কৃষক আমদানি করেন এবং সাঁওতালদের বিনা খাজনায় জমি জেলার নাগরিকত্ব প্রদান করেন (আলী, ২০০২) তখন থেকেই তারা দিনাজপুরে স্থায়ী হন। বর্তমানে অধিকাংশ আদিবাসীরা বসবাস করেন জেলার সদর, নবাবগঞ্জ, বীরগঞ্জ, রানীসংকৈল, বালুয়াডাঙ্গি ঘোড়াঘাট উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় (আলী, ২০০২) তারা মূলত কৃষিকাজ করে জীবিকানির্বাহ করেন। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী (২০১১ সালের শুমারিতে তাদের কোনো পরিসংখ্যান নেই) দিনাজপুরে আদিবাসী ছিল ৬১ হাজার ৭৪৪ জন। এর মধ্যে সাঁওতাল সম্প্রদায় ৫৩ হাজার ১১৪ জন এবং ওঁরাওসহ অন্যান্য হাজার ৬৩০ জন।

আঠার শতকের শেষভাগে জেলার মাটিতে প্রথম মিশনারিদের আবির্ভাব হয়। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রাক্তন দিনাজপুর জেলার অধীন মদনবাটি মহিপাল গ্রামে মিশন প্রতিষ্ঠা করেন আদিবাসীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে (আলী, ২০০২) ১৯৭১-এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের মিশনগুলোয় বিদেশী ফাদার থাকলেও বর্তমান দিনাজপুরের ১২টি মিশনে ফাদার, ব্রাদার সিস্টারদের মধ্যে কিছুসংখ্যক বিদেশী নাগরিক (ভারত, ইতালি) আছেন, যারা তাদের জীবনের অধিকাংশ সময় এখানেই কাটিয়ে দিচ্ছেন (তথ্যদাতা ফাদার আলবার্ট সরেন, সাময়িককালীন ফাদার, সুইহারি মিশনারি, দিনাজপুর, ২১/০৬/২০২২) ধর্মীয় বা শিক্ষা সুযোগদানের উদ্দেশ্যে।

দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলায় রয়েছে আঠার শতকে নির্মিত বিখ্যাত নবরত্ন কান্তজিউ মন্দির, যার নির্মাতা তত্কালীন মহারাজা প্রাণনাথ (হক এবং হক, ২০২০) মন্দিরের চারপাশে ছিল ঢেপা নদীর প্রবাহ। ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ, জনাকীর্ণ, ছিল বাঘের মতো ভয়ংকর সব প্রাণীর আবাসস্থল। লেখককে কান্তনগরের অভিবাসিত জনগোষ্ঠী জানিয়েছেন, ১৯৪৮- মূলত নদীভাঙনে ভারতের মালদহ রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বেঁচে থাকার তাগিদে ঘুরতে ঘুরতে কান্তনগর এলাকায় চলে আসেন তারা। পরবর্তী সময়ে মুসলিম জনগোষ্ঠী বুঝতে পারেন, যে জায়গায় তারা স্থায়ী আবাস গড়েছেন তা মূলত মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তি। ১৯৭৫-৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাদের উচ্ছেদ না করে বরং তাদের সঙ্গে চুক্তি করেন এবং সে সময়ে বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারকে (৪০টি পরিবার) সরকার ২৫ ডেসিমেল করে মন্দিরের জমি দেন। বর্তমানে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামটিতে মন্দির দর্শনে গেলে লেখকের মতো যে কেউ অবাক হতে পারেন কান্তনগরের মানুষের মুখে চাঁপাইয়ের আঞ্চলিক ভাষায় কথা শুনলে। কান্তনগর ছাড়াও কাহারোলের সুলতানপুর বাগান গ্রামেও জনগোষ্ঠীর অনেকে বসবাস করেন।

কান্তজিউ মন্দির থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত হিন্দু অধ্যুষিত একটি গ্রাম নয়াবাদ। যে গ্রামে আছে ঐতিহাসিক নয়াবাদ মসজিদ কান্তজিউ মন্দির আর নয়াবাদ মসজিদের কারিগররা ছিলেন মুর্শিদাবাদ থেকে আগত। সে সময় মহারাজ প্রাণনাথ মন্দিরের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে বহিরাগত মিস্ত্রিদের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদ নির্মাণ এবং বসবাসের নিমিত্তে জমি দান করেন গ্রামে। সে থেকে মুর্শিদাবাদের মিস্ত্রিরা এখানে বসবাস করছেন। বর্তমান সে পাড়ায় রয়েছে মিস্ত্রিদের ষষ্ঠ সপ্তম প্রজন্ম। লেখককে মিস্ত্রিদের ষষ্ঠ প্রজন্মের আব্দুস সালাম সাক্ষাত্কার দেয়ার সময় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। বরাবরই যেকোনো স্থাপনার ক্ষেত্রে নির্মাণে যিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেন ইতিহাস তাদের স্মরণ করে। কিন্তু যে কারিগর বা মিস্ত্রিদের হাতের স্পর্শে স্থাপনা অনন্য হয়ে ওঠে, তারা থাকে ইতিহাসের অগোচরে কিংবা কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। সালাম লেখককে শোনান সেই মিস্ত্রিদের নাম। কান্তজিউয়ের প্রধান মুসলিম মিস্ত্রি ছিলেন মিয়াজান। তার দুই সন্তান নেওয়াজ কালুয়া মিস্ত্রি। মূলত নয়াবাদ গ্রামে বসবাস করছে নেওয়াজ মিস্ত্রি। নেওয়াজ মিস্ত্রির ছেলে ছিল ভালে নেফাশা। নেফাশার ছেলে ছিল সিরাজ এবং তার ছেলে বর্তমান সালাম। সিরাজের সময় থেকেই মুর্শিদাবাদ থেকে আগত জনগোষ্ঠী নির্মাণকাজ ছেড়ে দেন। বর্তমান প্রজন্ম কৃষিকাজে জীবিকা নির্বাহ করছে (লেখকের কান্তজিউ মন্দিরের ওপর অপ্রকাশিত এমএস থিসিস থেকে উদ্ধৃত)

লেখক তার দল নিয়ে যখন ওপরে উল্লিখিত উত্তরদাতাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছিলেন উত্তরদাতারা অত্যন্ত উচ্ছ্বাস নিয়ে বলছিলেন, দিনাজপুরের মতো অসাম্প্রদায়িক এলাকা বাংলাদেশে হয়তো খুব কমই আছে। এখানে হিন্দু মুসলমানরা একে-অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। এখানে সারা বছরে নানা ধর্মীয় উৎসবে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে আসে হিন্দু-মুসলমান সবার মাঝে, তাতে বোঝা কঠিন কোনটা কার উৎসব। সামাজিক সম্প্রীতি এখানে অটুট। এক সময় জেলায় হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকলেও বর্তমানে মুসলিমরা সংখ্যাগুরু। কিন্তু তাতে কী? অতীতের দিনাজপুর যেমন ছিল বাংলাদেশের অন্যতম অসাম্প্রদায়িক জেলা, বর্তমানের দিনাজপুরও বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণের লোকদের এমনকি অভিবাসী, আদিবাসীদের কাছে সুখ-শাান্তিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আবাসভূমি তাই তো কবি রফিক আজাদ তার প্রতীক্ষা কবিতায় বলেছিলেন

...চল তোকে দিনাজপুর নিয়ে যাবো

কান্তজীর মন্দির রামসাগর দেখবি,

বিরাট গোলাকার চাঁদ মস্ত খোলা আকাশ দেখবি,

পলা আধিয়ারের জীবন দেখবি,

গল্প-টল্প লেখার ব্যাপারে কিছু উপাদান

পেয়ে যেতেও পারিস,

তৈরী থাকিস- আমি আসবো

 

গ্রন্থসূত্র

১। আলী, এম. (২০০০). দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র-. দিনাজপুর: দিনাজপুরের ইতিহাস প্রকাশনা প্রকল্প।

২। আহমেদ, .. (ইডি.). (১৯৯৬). বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, ঢাকা।

৩। Akram. A.B.(2021). The Intangible Cultural Significances of Heritaeg: A study on Kantajew Temple, Dinajpur (Unpublished Master’s Thesis). Khulna University, Khulna, Bangladesh.

 

আশরাফী বিনতে আকরাম: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

-মেইল: [email protected]

 

গবেষণায় সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন: ফাতেমা তুজ জোহরা (সমাজবিজ্ঞান), মুহা. সাঈদ হাসান (কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং) শেখ রিয়াদ (সমাজবিজ্ঞান) (শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)