সিল্করুট

দিনাজের শহর

অমিত রহমান

সতেরো শতক থেকে দিনাজপুর নামটির প্রচলনের কথা জানা যায়। কথিত, দিনাজ নামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি তার পরিবার নিয়ে অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে স্থানটি দিনাজপুর নামে পরিচিত হয়। দিনাজপুর মানে দিনাজের শহর। অবশ্য ভিন্নমতও আছে। কেউ কেউ বলেন রাজা গণেশের নামানুসারে দিনাজপুর। রাজা গণেশ ক্ষমতায় বসে দনুজ মর্দনদেব নাম নিয়েছিলেন। ফার্সিভাষী পণ্ডিতরা দনুজ শব্দটি দিনওয়ায় হিসেবে উচ্চারণ করতেন। এরপর শব্দটি আরো বিবর্তিত হয়ে দিনওয়াজ অর্থাৎ দনুজ-দন--দন-ওয়া-দিন-ওয়া- রূপ ধারণ করে। সতেরো শতকে মুসলিম শাসকরা শব্দটি দিনওয়াজ হিসেবে উচ্চারণ শুরু করেন। এটি বাংলা উচ্চারণে দিনাজ হয়ে যায়। এখান থেকেই আসে দিনাজপুর। ফার্সি ভাষায় রাজা গণেশ দনুজ মর্দনদেবকে বলা হতো দিওয়ান--দিন-পয়ায তিনি দিনাজের হাকিম। ব্রিটিশরা পরবর্তী সময়ে গণেশকে সম্বোধন করেছিলেন Perhaps a petty Chief of Dinwaj বাংলায়দিনাজের এক সামন্ত। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যায়, দিনাজপুর নামটি প্রাচীন নয়। শহরের নামকরণ নিয়ে আরো একটি অনুমান পাওয়া যায়। কালিকানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক রাজা সন্ন্যাসী হয়ে নিজের জমিদারি দান করেছিলেন সুকদেব রায়কে। সুকদেবের নাতি রাজা রামনাথ দিনাজপুর শহরকে ভিত্তি দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। জমিদার হয়েও দীন-দরিদ্র জীবনযাপন বেছে নেয়ায় কালিকানন্দের স্মরণে রামনাথ শহরের নাম দেন দীনরাজপুর। স্থানীয় উচ্চারণে তা এক সময় হয়ে যায় দিনাজপুর।

দিনাজপুরের ভূমি অতিপ্রাচীন। সেকালে জেলা পুন্ড্রবর্ধন ভুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। কোটিবর্ষ (বর্তমানে বাণগড়) পঞ্চনগরীর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। একসময় জেলার উত্তরাঞ্চল প্রাগজ্যোতিষ পরবর্তী সময়ে কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিংবদন্তি আছে, পৃথ্বিরাজের রাজধানী ছিল জেলার ভিতরগড়ে। খ্রিস্টপূর্ব চার শতাকে পুণ্ড্রবর্ধন মৌর্য শাসনাধীন ছিল। খ্রিস্টীয় তিন শতকে এখনকার দিনাজপুর ছিল গুপ্ত শাসনের অধীন। জেলায় প্রাপ্ত বিভিন্ন লিপি থেকে জানা যায়, এলাকা দীর্ঘদিন গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। আট শতকে দিনাজপুর পাল বংশীয় শাসনের অধীন হয়। পাল আমলে দিনাজপুর অঞ্চলে কৈবর্তদের বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল।

১২০৪ অথবা ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি নদীয়া জয় করেন। এক সময় তার শাসন বিস্তৃত হয় দিনাজপুরের দেবকোটে। ইতিহাসবিদ আবদুল করিম লিখেছেন, বখতিয়ারের রাজ্যসীমা পূর্বে তিস্তা করতোয়া নদী, দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর শহর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এখানে তিনি দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তী মুসলিম শাসকদের মধ্যে একজন ছিলেন রুকনউদ্দিন কায়কাউস (১২৯১-১৩০০) তার আমলে শাহাব উদ্দিন জাফর খান দিনাজপুরের দেবকোটে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। একই সময়ে এখানে একটি মাদ্রাসাও স্থাপিত হয়। বলা হয়, এটিই বাংলায় তৈরি প্রথম মাদ্রাসা।

তের শতকে দিনাজপুর অঞ্চলে সুফিদের আগমন পরিলক্ষিত হয়। তাদের মাধ্যমে এখানে মুসলিম সমাজের বিস্তার ঘটে। পর্যায়ে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ সুফি ছিলেন শাহ নাসির উদ্দিন নেকমর্দান, পীর বদরুদ্দিন মওলানা আতা শাহ।

ঐতিহাসিক একডালা দুর্গটি আদি দিনাজপুরে অবস্থিত। এখানেই দিল্লিশ্বর ফিরোজ শাহের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন বাংলার শাসক ইলিয়াস শাহ। শেষোক্তের পক্ষে লড়েছিলেন দিনাজপুরের পাইকরা। একডালা দুর্গ বর্তমানে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুরে অবস্থিত। পনের শতকের বাংলার শাসক রাজা গণেশ ছিলেন দিনাজপুরের বাসিন্দা। পরবর্তী সময়ে বাংলার মসনদে বসেন তার পুত্র যদু।

দিনাজপুরের রাজবংশের ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, দিনাজপুর অঞ্চলের জমির মালিক ছিলেন শ্রীমন্ত চৌধুরী। তার কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। একমাত্র কন্যা ছিলেন লীলাবতী। রংপুর জেলার বর্ধনকুঠির রাজপুত্র হরিনারায়ণের সঙ্গে লীলাবতীর বিয়ে হয়। তাদের একমাত্র পুত্র সুকদেব। সুকদেব দিনাজপুর রাজবংশের প্রথম রাজা। রাজা হিসেবে সুকদেবের আবির্ভাবকাল ছিল ১৬৪০-৭৭ খ্রিস্টাব্দ। এরপর প্রায় ৩০০ বছর স্থায়ী রাজবংশে ১১ জন রাজা রাজত্ব করেন। এরা ছিলেন সুকদেব, রামদেব, জয়দেব, প্রাণনাথ, রামনাথ, বৈদ্যনাথ, রাধানাথ, গোবিন্দনাথ, তারকনাথ, গিরিজানাথ জগদীশনাথ। রাজারা অধিকাংশই ছিলেন রাজপরিবারের দত্তকপুত্র।

বাংলাদেশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের সূচনায় সৃষ্ট আদি জেলা শহরগুলোর অন্যতম দিনাজপুর। ইংরেজ সেনারা পলাশী যুদ্ধের আট বছর পর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে এলাকা জয় করে। ফলে নবাবি শাসনের অবসানের সঙ্গে পতন হয় সাবেক রাজধানী ঘোড়াঘাট নগরের। তারপর গড়ে উঠতে শুরু করে দিনাজপুর শহর।

১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে জেলা শাসনের জন্য দিনাজপুরে স্বতন্ত্র স্থায়ী কালেক্টরেট স্থাপিত হয়। তার আগ পর্যন্ত দিনাজপুর-রংপুর যুক্ত কালেক্টরেট ছিল। রাজসেরেস্তা থেকে নথিপত্র প্রত্যাহার করে জিলা স্কুলের পুরনো ভবনটিতে (সম্প্রতি ভেঙে ফেলা হয়েছে) কালেক্টর অফিস স্থাপিত হয়। জেলা স্কুল হওয়ার আগে ভবনটি রাজকাচারি ছিল। তখন কালেক্টর ছিলেন মি. ম্যারিওয়েট, রাজা ছিলেন রাজবংশের নাবালক উত্তরাধিকারী রাধানাথ।

১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সেনাপতি মি. কোট্রিল ঘোড়াঘাটের শেষ মুসলিম ফৌজদার করম আলী খানকে পরাজিত করে অঞ্চলে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। অঞ্চলে প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ইংরেজরা ১৭৮৬ সালে নতুন জেলা গঠন করে এবং ১৭৯৩ সালে দিনাজপুরে জেলার দপ্তর স্থাপন করে। দিনাজপুরের কালেক্টর মি. এইচ জে হ্যাচের (১৭৮৬-৯৩ পর্যন্ত কালেক্টর ছিলেন) আমলে দিনাজপুরে প্রথম নিজস্ব কালেক্টরেট ভবন নির্মিত হয় বর্তমান বাহাদুর বাজারের গোলকুঠি বাড়িতে। জেলা কালেক্টরেট নির্মিত এবং সেই সঙ্গে সুবিন্যস্ত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় আধুনিক জেলা শহরটির গড়ন শুরু হয় রাজাদের দেয়া কয়েকটি মৌজার ওপর। রাজবাড়ী থেকে সব নথিপত্র প্রত্যাহার করে গোলকুঠি ভবনে আনা হয়। মোগল আমলের ঘোড়াঘাটনগর তখন সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত। দিনাজপুর শহর তখন জেলা শাসনের কেন্দ্র সবকিছুর কর্মস্থলে পরিণত হতে শুরু করে। ১৮৩৩-৭০ পর্যন্ত দিনাজপুরের বিভিন্ন অংশ পূর্ণিয়া, রংপুর রাজশাহীর মধ্যে অন্তর্ভুক্তি বিচ্যুতি ঘটে।

১৮০০-০১ খ্রিস্টাব্দে দিনাজপুরের বড় বড় এস্টেট পূর্ণিয়া, রংপুর রাজশাহী জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে আর একটি সুবিস্তৃত অংশ বগুড়া মালদহ জেলার সঙ্গে যুক্ত করার পূর্ব পর্যন্ত আর কোনো রদবদল করা হয়নি। ১৮৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে খট্রা নামক একটি সুবিশাল পরগনাকে জেলা হতে ছেঁটে বগুড়া জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৮৬৮-৭০ সালের দিকে জেলার একটি বৃহৎ অংশ বগুড়া মালদহ জেলায় যুক্ত হয়।

ব্রিটিশ আমলের দিনাজপুর জেলা বর্তমানে ছয় খণ্ডে বিভক্ত। বাংলাদেশে বর্তমান দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড়, ভারতে উত্তর দক্ষিণ দিনাজপুর ছাড়াও ভারতের জলপাইগুড়ি কোচবিহার জেলার কিছু অংশ এবং বাংলাদেশের বর্তমান নওগাঁ জেলার কিছু অংশ ইংরেজ আমলে দিনাজপুর জেলার অংশ ছিল।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুসারে জেলার ১০টি থানা ভারতের পশ্চিম বাংলা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পশ্চিম দিনাজপুর জেলা গঠন করে। অন্যদিকে পশ্চিম বাংলার জলপাইগুড়ি জেলা হতে তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়, বোদা, দেবীগঞ্জ পাটগ্রাম থানা দিনাজপুরের সঙ্গে যুক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকার শাসনকার্যের সুবিধার্থে পাটগ্রাম থানাটি রংপুরের সঙ্গে এবং দিনাজপুরের দক্ষিণ অংশের ধামইর, পোরশা পত্নিতলা থানা তিনটি তত্কালীন রাজশাহীর নওগাঁ মহকুমার সঙ্গে যুক্ত করে। সর্বশেষ ১৯৮৪ সালে দিনাজপুরের দুটি মহকুমা ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড় আলাদা জেলার মর্যাদা লাভ করে।

 

অমিত রহমান: লেখক